ধানের মুড়ি ফসল কৃষিতে নতুন বিপ্লব

শেরপুরে নালিতাবাড়ী উপজেলায় এখন বোরো ধানের জমিতে মুড়ি ফসল হচ্ছে। উপজেলার পোড়াগাঁও, নন্নী, রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নালিতাবাড়ী সদর, রূপনারায়ণকুড়া, নয়াবিল ইউনিয়ন এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার কিছু এলাকায় মুড়ি ফসল বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিআর-২৬ ও ব্রি ধান-২৮ জাতের জমিতে মুড়ি ফসল বেশি হলেও হাইব্রিড জাতের কিছু ধানের জমিতেও মুড়ি ফসল দেখা যায়। একর প্রতি গড়ে ১০-১৪ মণ ধান পাচ্ছেন কৃষকরা। তবে শীষ আসার সময় যে সকল কৃষকগণ সামান্য যত্ন নিয়েছেন তারা ফলন পাচ্ছেন একর প্রতি ১৬-২০ মণ।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মুড়ি ফসলকে ইংরেজিতে বলে ‘রোটন ক্রপ’। বিশেষত ধান, আখ, কলায় মূল ফসল কাটার পর অবশিষ্টাংশ গোড়া থেকে পুনরায় গাছ হয় ও ফলন পাওয়া যায়। একেই মুড়ি ফসল বলে।

মুড়ি ফসলে চাষ, লাগানো ও অন্যান্য যত্ন কম নিতে হয়। তাই ফলন কম হলেও চাষের খরচ কম হয় বিধায় কৃষকের লাভ হয়। তবে কিছু যত্ন যেমন আগাছা ও মরা পাতা পরিষ্কার করে দেয়া, ছত্রাকনাশক স্প্রে করা এ সকল পরিচর্যা করলে ফলন বাড়ে। এবার বোরো ধান কেটে ঘরে নেয়ার দেড়-দুই মাস পর ওই জমি থেকেই বিনা খরচে একর প্রতি ১০-১২ মণ ‘মুড়িধান’ উৎপাদন করে দারুণ খুশি কৃষকরা। কোথাও কোথাও আবার ২০-২৫ মণ করেও মুড়িধান হয়েছে। বোরোর এ মুড়িধানকে আউশ আবাদের বিকল্প হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছেন স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।

নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি এলাকার কৃষকরা জানান, কোনো রকম খরচ ছাড়াই তারা মুড়ি ধান পেয়েছেন। মূল বোরো ধান কাটার ১৫-২০ দিনের মধ্যেই পতিত নাড়ার মধ্যে শীষ আসে। এর ২০-২৫ দিনের পর ধান পাকে। দেখা যায়, মূল ধান কাটার পর ৪৫-৫০ দিনের মধ্যেই আবার এ ফসল কাটতে পারেন কৃষকরা। যে সকল জমিতে ধান দেড়-দুই ফুট উঁচুতে কাটা হয়েছে, সে সকল জমিতে মুড়ি ফসল পাওয়া যায়। নালিতাবাড়ী উপজেলায় এ বছর বোরো ধান কাটা শুরু হয় এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে। আর মুড়ি ফসল কাটা শুরু হয় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। এখন মুড়ি ফসল কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে।

 

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, নালিতাবাড়ী উপজেলায় এ বছর প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমির মুড়ি ফসল কেটেছেন কৃষকরা। মুড়ি ফসলের এবারের ফলন আগামী বছর কৃষকদের এ ফসলের প্রতি আরও যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করবে। এ বিষয়ে কৃষি বিভাগ থেকে স্থানীয়ভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে। কৃষকদের মাঝে মুড়ি ধান সুরক্ষায় লিফলেট বিতরণসহ প্রশিক্ষণে মাধ্যমে এই ফসলের যত্ন ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করা হয়। বিশেষ করে মূল বোরো ধান কাটার পরপরই একরে ১৫ কেজি ইউরিয়া ও ১৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। এর সঙ্গে গবাদী পশু যেন মুড়ি ফসলের ক্ষতি করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কালাকুমা গ্রামের মো. মোস্তফা বলেন, সাত কাডা (৩৫ শতক) জমিতে ‘পাইওনিয়ার’ জাতের বোরো ধান লাগাইয়া ২০ মণ ফলন পাইছিলাম। অহন কাটা ধানের গোড়া থাইক্কা কোনো যত্ন ছাড়াই ধান পাইছি আরও ৫ মণ। অহনা এই ধান বেচার টাকা দিয়া আমন ধানের বীজতলা তৈয়ারি করছি। এতে আমায় প্রায় এক একর আমন ক্ষেত চাষাবাদের জন্য খরচের চিন্তা করতে অইতাছে না।

হাতিবান্দা গ্রামের কৃষক মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, ২২ কাঠা জমিতে ‘মুড়িধান’ ফলন হয়েছে ১৫ মণ। শুধুমাত্র ধান কাটানোর ব্যয় ছাড়া পুরোটাই তার লাভ বলে জানান।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফ ইকবাল জানান, নালিতাবাড়ী উপজেলায় বোরো ধানের জমিতে মুড়ি ফসল দেখে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে গবেষণা করার নির্দেশনা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে গবেষকগণ নালিতাবাড়ী থেকে মুড়ি ফসলের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতের বোরো ধানের জমিতে ব্যাপক আকারে মুড়ি ফসল পাওয়া গেলে তা হবে কৃষকের জন্য আশীর্বাদ। যদি সঠিক পরিচর্যা করে এর ফলন আরও বাড়ানো যায়। তাছাড়া মুড়ি ধান এ অঞ্চলে আউশ ধানের বিকল্প ফসল হতে পারে বলে আশা করা যায়। এতে করে শুধু কৃষকরা লাভবানই হবেন না, পতিত জমির মুড়ি ফসল কিছুটা হলেও যোগান দিবে দেশের খাদ্য ভাণ্ডারে।

শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আশরাফ উদ্দিন জানান, এবার নালিতাবাড়ী উপজেলায় মাত্র ৭০০ হেক্টর আউশ জমির বিপরীতে‘মুড়িধান’আবাদ হয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। একর প্রতি ফলন হয়েছে ১০-১২ মণ হারে। এতে‘ফাউ’ধান পেয়ে কৃষকরাও দ্বিগুন উৎসাহিত হয়েছে। তিনি বলেন, বোরোর এ মুড়িধানকে আউশ আবাদের বিকল্প হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছেন স্থানীয় কৃষকরা।